দীর্ঘ ২৮ ঘন্টার যাত্রাপথ। মনে মনে তৈরী হয়ে নিয়েছিলাম আরেকটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য। আমার রাউট ছিলো ড্যালাস- ফ্র্যাঙ্কফোর্ট – বাহারাইন – ঢাকা। ড্যালাস থেকে আমার যাত্রাসঙ্গী ছিলো এক কালো জাপানি লোক। সে আমি ঘুমালেই আমার ব্ল্যাঙ্কেট ঠিক ঠাক করে দেয়। প্রথমবার ভাবলাম- কেয়ারিং সহযাত্রী। দ্বিতীয়বার মনে হল এই লোকের সমস্যাটা কি?? তার বসতে অসুবিধা হলে পাশের দুটো সিট তো খালি... আমার সামনে বসেছিলো এক বিশালদেহী আমেরিকান,- সে ভাইয়ের পরিবারকে সাহায্য করছিলো ফ্র্যাঙ্কফোর্ট যেতে। আমি তার সাথে ভাব জমিয়ে ফেললাম অনেকটা ক্রিপি জাপানীজকে একটু সমঝানোর জন্যই। একটু কথার পরই সে আমাকে তার কান্ট্রি হাউসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেললো। আমি মনে মনে “আলহামদুলিল্লাহ!!” বলে কেটে পড়লাম। ১০ ঘন্টার ফ্লাইটে আর কতক্ষণ জেগে থাকা যায়!! একটু পর আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাংলো ক্রিপি জাপানীজের ডাকে। ঘুম ভাঙ্গিয়ে জিজ্ঞেস করে – “ হাউ ইয়্যু ডুয়িং? “ আমি তাকে ভস্ম করে ফেলব টাইপ একটা দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারলাম না । সে বলে তুমি কী জাপানিজ মুদ্রা চাও? হঠাত ঘুম ভাংলে আমার মাথা কাজ করে না, আমি কেবল ঘাড়টা একটু কাত করলাম। সে প্রবল উতসাহে আমাকে তার মুদ্রা সংগ্রহের গল্প বলা শুরু করল। আমিও মাথা নেড়ে গেলাম। যাওয়ার আগে সে আমাকে একটা জাপানীজ মুদ্রা দিলো সংগ্রহে রাখার জন্য।
প্রচন্ড ঠান্ডায় স্থানীয় সময়, সকাল ৭ টায় এসে পৌঁছালাম ফ্র্যাঙ্কফোর্টে । এখানে আমার ৪ ঘন্টার মত যাত্রা বিরতি। আমাকে অবতরণ টার্মিনাল থেকে সাটল ট্রেনে করে বহির্গমণ টার্মিলালে যেতে হবে। সাটলে আমার সাথে উঠলো এক পাজিঁ। সে সবার সাথে ইয়ার দোস্ত টাইপের আচরণ করতে করতে আমার কাছে এসে বলে –সে আর তার সঙ্গী ফ্র্যাঙ্কফোর্ট দেখতে যাচ্ছে, আমি তাদের সাথে যেতে চাই নাকি। আমি ভদ্রভাবে মানা করে দিলাম। কিন্তু এদের উতসাহ অপরিসীম। আমাকে সাহায্য করতে বদ্ধপরিকর। ওরা আমাকে অনুসরণ করা শুরু করলো। যেখানেই যাই ওরা দু’জন। এত ভোরে বিমানবন্দর প্রায় খালি। কিছু আপদমস্তক কালো বোরকায় মুড়ানো মহিলা দেখলাম। আমি ভাবছি উজি ম্যেশিগানওয়ালা পুলিশকে বলবো নাকি? শেষে কী মনে করে ঠিক করলাম আমি নিজেই কনফ্রন্ট করবো। আমি জিজ্ঞেস করলাম-“ তোমাদের কাহিনী কী ? আমাকে অনুসরণ করছো কেন?? “
তারা আমাকে ড্রিঙ্কের আমন্রণ জানালো। ভাবলাম একা একা বসে থাকার চেয়ে দু’জন সঙ্গী পাওয়া গেলে মন্দ হয় না। কথায় কথায় জানলাম তারা গায়ক। দুবাই থেকে শো করে টরান্টো ফিরছে। আমি বললাম গান শোনাও। তারা একটা গান গাইলো পাঞ্জাবী ভাষায়। নানা উল্কিওয়ালা জার্মানভাষী দোকানদারও দেহাতি দেয়া শুরু করলো। কিন্তু ড্রিঙ্কের দাম দেয়ার সময়ই পাঁজির ভারতীয় চামড়া বেরিয়ে পড়লো। শুরু করলো দাম কষাকষি। একথা সেকথা বলে দোকানদারকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। আমি আমার পানীয়ের দাম দিয়ে কেটে পড়লাম। আমি খেটে খাওয়া মানুষের সাথে দরদাম করা মারাত্মক অপছন্দ করি।
ফ্র্যাকফোর্ট থেকে বাহারাইনের ফ্লাইট প্রায় ফাঁকা ছিলো। তিন সিট নিয়ে ঘুমিয়ে ৮ ঘন্টা পার করে দিলাম। বাহারাইনে নেমেই দেখি অনেক বাংলাদেশী মানুষ। সবারই মনে আনন্দ, দেশে যাচ্ছে। একজন কিছু বলে , বাকীরা হেসে গড়িয়ে পরে, কেউ মেতে উঠেছে শেয়ার বাজার নিয়ে তুমুল আলোচনায়। মনে হয় যেন সবাই সবার চেনা। বিমানের ক্রুদের ব্যবহার এই ফ্লাইটে খুবই খারাপ। ডেকেও কাউকে পাওয়া যায় না। যাত্রীরাও দেখি কারও সাহায্যের আশা ও করছে না। যে যেভাবে পারছে অন্যকে সাহায্য করছে। আমি তিনবার ডেকেও ব্ল্যঙ্কেটের দেখা পেলাম না। হঠাত একজন ওভারহেডে কিছু ব্ল্যাঙ্কেট আবিষ্কার করে, সবাইকে হাতে হাতে দিয়ে দিলো। সদ্য গোঁফ ওঠা কিছু ছেলে পেলে হঠাত খবর পেলো প্লেনে ফ্রি বিয়ার দেয়া হচ্ছে। পোলাপাইনের মধ্যে প্রায় ঈদের আনন্দ। বোঝাই যায় এদের পান করে অভ্যাস নেই। কিন্তু ফ্রি না খাওয়াও পাপ। তাই একজন করে গিয়ে একটা ক্যান নিয়ে আসে, কিন্তু আর শেষ করতে না পেরে পাশের জনকে দিয়ে দেয়। পাশের জন উঠে আরেকটা নিয়ে আসে, সেও শেষ না করে পাশের জনকে দিয়ে দেয়। পুরো প্লেন জুড়ে বিয়ারের কটু গন্ধ। সাথে আমার পাশের মহিলার জর্দা পানের গন্ধ, সব মিলিয়ে গান্ধমাদন দশা। এর মাঝেই বিমানচালক ঘোষণা দল আর ২০ মিনিটের মাঝেই আমারা ঢাকায় অবতরণ করবো। সবাই প্লেনের ছোট্ট জানালা দিয়ে ঢাকা খুজঁতে লাগলো।
হঠাত জীবনে প্রথম বাংলাদেশে আসা একটা বাচ্চা চিত্কার দিয়ে ওঠে “ওইটা বাংলাদেশ, ওইটা বাংলাদেশ !!!”
Comments
Post a Comment